উচ্চ রক্তচাপ -এর রোগীরা যেসব নিয়ম মেনে চলবেন এবং যেসব খাবার খাবেন
উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভোগেন অনেকেই। এই সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যেকোনো বয়সেই দেখা দিতে পারে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা। আর একবার এই সমস্যা দেখা দিলে জীবনযাপন নিয়ন্ত্রিত রাখতে হয়। কারণ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না রাখলে তা আরও অনেক অসুখের কারণ হতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ থেকে কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের মতো মারাত্মক রোগ হতে পারে। এসব রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানা আছে নিশ্চয়ই! তাই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই একদমই।
উচ্চ রক্তচাপের কারণ
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, স্থুলতা, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি কারণে দেখা দিতে পারে উচ্চ রক্তচাপ এবং এ সম্পর্কিত নানা সমস্যা। শরীরের সোডিয়ামের স্তরকে উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী মনে করা হয়। কারণ, সোডিয়াম আমাদের রক্তে ফ্লুইডের পরিমাণ ও সমতা বজায় রাখে। আমরা যে লবণ খাই তাতে থাকে ৪০ শতাংশ সোডিয়াম। কিছু খাবার আছে যেগুলোতে লবণের পরিমাণ বেশি থাকে। সেগুলো উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দিলে খাবারের দিকে নজর দেয়া খুব জরুরি।
খাবার নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থেকে দূরে থাকা সম্ভব। খাবারের তালিকায় তাই আনতে হবে পরিবর্তন। কিছু খাবার যোগ এবং কিছু খাবার বিয়োগ করতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ হলে কিছু খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় যেসব খাবার বাদ দিতে হবে-
1. চিনি হতে পারে বিপদের কারণ
মিষ্টি স্বাদের খাবার খাওয়ার জন্য যতই মন কেমন করুক না কেন, উচ্চ রক্তচাপ হলে চিনিযুক্ত খাবার একেবারেই বাদ দিতে হবে। অতিরিক্ত মিষ্টি খেলে আমাদের শরীরে মেদ জমতে থাকে। এর ফলে ওজন বেড়ে যায়। অনেকে বাড়তি ওজনের কারণেই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় আক্রান্ত হন। চিনি বেশি খেলেও শরীরে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।
2. চিজ খাওয়া বাদ দিন
চিজ বা পনির খেতে সুস্বাদু হলেও এটি উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের বাদ দিতে হবে। কারণ এটি এমন এক খাবার যাতে সোডিয়ামের পরিমাণ থাকে অত্যন্ত বেশি। পনিরের মাত্র দুটি টুকরায় থাকে ৫১২ মিলিগ্রাম সোডিয়াম। এই খাবারে থাকে স্যাচুরেটেড ফ্যাটও। ফলে পনির খেলে রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল দুটিই বেড়ে যায়।
3. এড়িয়ে চলুন রেড মিট
খেতে যতই পছন্দ করুন না কেন, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দিলে আপনাকে রেড মিট অর্থাৎ গরু, খাসি এবং মহিষের মাংস খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। কারণ এধরনের মাংসে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকে। ফলে স্ট্রোক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
4. ফাস্টফুড যে কারণে ক্ষতিকর
উচ্চ রক্তচাপ হলে বিদায় জানাতে হবে ফাস্টফুডকে। কারণ এ ধরনের খাবারেই উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টিকারী উপাদান সবচেয়ে বেশি থাকে। এ জাতীয় খাবারে প্রচুর সোডিয়াম, প্রিজারবেটিভ, বিষাক্ত রঙ এবং ক্ষতিকারক চর্বি ব্যবহার করা হয়। উচ্চ রক্তচাপের রোগীর জন্য এসব উপাদান ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
5. কফি খেলে যে সমস্যা হয়
উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় আরেকটি খাবার ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেটি হলো কফি। এর কারণ হলো ক্যাফেইন আমাদের রক্তনালীকে সরু করে ফেলে। ফলে হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে। আপনার যদি উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকে তবে চা কিংবা কফি কোনোটাই পান না করা ভালো। এর বদলে চিনি ছাড়া গ্রিন টি খেতে পারেন।
6. যে কারণে লবণ খাবেন না
উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দিলে প্রথমেই বাদ দিতে হবে লবণ। আমাদের শরীরে অতিরিক্ত সোডিয়াম জমে গেলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। তাই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে লবণ থেকে দূরে থাকতে হবে। খাবার তৈরির সময়ও লবণের পরিমাণ কমিয়ে দেবেন। খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা বাদ দিতে হবে।
7. অ্যালকোহল যে করণে বাদ দিবেন
অ্যালকোহল পান করলে বাড়ে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি। তাই অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় পান করার অভ্যাস থাকলে তা বাদ দিন। অ্যালকোহল গ্রহণ করলে তা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।
উচ্চ রক্তচাপের রোগীর খাবার
উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে
উচ্চ রক্তচাপ কেবল ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, এ জন্য দরকার জীবনাচরণে পরিবর্তন ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের রোগীদের গবেষকেরা ড্যাশ (ডায়েটারি অ্যাপ্রোচ টু স্টপ হাইপারটেনশন) ডায়েট অনুসরণ করতে বলেন। এটি খুবই সহজ এবং সাধারণ। এই ডায়েটের মূল বিষয় চারটি—
১. প্রচুর তাজা ফলমূল, শাকসবজি ও দুগ্ধজাত খাবার খেতে হবে।
২. সম্পৃক্ত চর্বি, উচ্চ কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার ও ট্রান্সফ্যাট পরিহার করতে হবে।
৩. গোটা শস্যের তৈরি খাবার, বাদাম, মাছ ও মুরগি খাওয়া যাবে।
৪. সোডিয়াম, চিনি, চিনিযুক্ত পানীয় ও রেডমিট গ্রহণ সীমিত রাখতে হবে।
গবেষকেরা বলেন, ড্যাশ ডায়েট চর্চা করলে রক্তচাপ মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব।
কীভাবে শুরু করবেন?
ড্যাশ ডায়েটের শুরুতে প্রথমেই লবণ বা সোডিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করুন। ২৪ ঘণ্টায় নিজের জন্য ২৪০০ মিলিগ্রাম বা এক চা–চামচ পরিমাণ লবণ বরাদ্দ করুন। মনে রাখবেন, এই পরিমাণ রান্না করা খাবারসহ হিসাব করতে হবে।
দুপুর ও রাতের খাবারে শাকসবজির পদ অবশ্যই রাখবেন।
সকাল ও বিকেলের নাশতায় রাখুন তাজা ফলমূল।
মাখন, মার্জারিন, সালাদ ড্রেসিং–জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো। খেতে হলে লো ফ্যাট, লো সোডিয়াম বেছে নিন।
প্রতিদিন লো ফ্যাট বা স্কিমড মিল্ক (ফ্যাট তোলা দুধ) বা দুগ্ধজাত খাবার রাখুন তালিকায়।
স্ন্যাক্স হিসেবে চিপস, ফাস্ট ফুড বা ডেজার্ট–জাতীয় খাবারের বদলে বেছে নিন লবণহীন বাদাম, টকদই, কিশমিশ, পপকর্ন ইত্যাদি।
যেকোনো খাবার কেনা বা অর্ডার দেওয়ার আগে লবণের পরিমাণ দেখে নিন। সয়াসস, টেস্টিং সল্ট, কেচাপ, আচার ইত্যাদি দিয়ে তৈরি খাবারে লবণ বেশি থাকে।
পেইন কিলার খেলে লিভার-কিডনিসহ্ শরীরের যেসব ক্ষতি করে
কী কী খাবেন না
কলিজা, মগজ, হাড়ের মজ্জা। এই অংশগুলোতে বেশি পরিমাণ কোলেস্টেরল থাকে। ক্যালরি এবং ফ্যাট কম থাকলেও চিংড়িতে আছে প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরল। সাড়ে তিন আউন্স চিংড়িতে আছে ১৮৯ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল।
মাছের মাথা, ডিম। রক্তের লিপিড প্রোফাইল বাড়িয়ে দেয় যেসব উপাদান, সেই এলডিএল বা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের উৎস হচ্ছে মাছের মাথা বা মাছের ডিম।
নিয়মিত যাঁরা সপ্তাহে একবার ফাস্ট ফুড খান, তাঁদের ক্ষেত্রে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। যাঁরা একের বেশি অর্থাৎ দুই–তিনবার খান, তাঁদের হার আরও বেশি, ৫০ শতাংশ।
ঘি ও মাখনে আছে উচ্চমাত্রার স্যাচুরেটেড ফ্যাট। সেই সঙ্গে আছে পামিটিক অ্যাসিড, যা আর্টারি ব্লকের কারণ হতে পারে। বদলে জলপাই তেল, সূর্যমুখী তেল বা মার্জারিন ব্যবহার করা যেতে পারে।
খাবারে নারকেল ও পাম তেল ব্যবহারের প্রবণতা খারাপ। নারকেল তেলের ৮৫ থেকে ৯০ ভাগই স্যাচুরেটেড ফ্যাট।
খাবার যত ভাজা বা ডিপ ফ্রাই হয়, তত তাতে যুক্ত হতে থাকে ক্ষতিকারক ফ্যাট। ডিপ ফ্রাই করা হলে তেল ট্রান্সফ্যাটে রূপান্তরিত হয়। এসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
রেডমিটে কেবল কোলেস্টেরল বেশি তা নয়, রেডমিট ভেঙে কারনিটাইন নামে একটি যৌগ দেহে তৈরি হয়, যা ট্রিমাথাইলেমাইন এন অক্সাইড নিঃসরণ করে। এটি এথেরোসক্লেরোসিসে ভূমিকা রাখে।
কেবল লবণ নয় চিনিযুক্ত পানীয়ও রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। যকৃতে চর্বি হিসেবে জমা হয়। কেক, পেস্ট্রি, পুডিং, আইসক্রিম ইত্যাদি খাবার চিনিযুক্ত।
উচ্চ রক্তচাপের রোগীর খাদ্যতালিকা
একজন প্রাপ্তবয়স্ক উচ্চ রক্তচাপের রোগীর খাদ্যতালিকা যেমন হতে পারে—
সকালের খাবার: হাতে বানানো লাল আটার রুটি ২–৩টি, মিশ্র সবজি ১ কাপ, ডিম সেদ্ধ ১টি, রং চা ১ কাপ।
দিনের মধ্যভাগের স্ন্যাক্স: যেকোনো কম মিষ্টিজাতীয় ফল ১-২টি।
দুপুরের খাবার: ভাত ২ কাপ, সবজি অথবা শাক ১ কাপ, ১ টুকরা বড় মাছ (সপ্তাহে ১ দিন সামুদ্রিক মাছ), ডাল ১ কাপ, সালাদ আধা কাপ।
সন্ধ্যার নাশতা: আগে ভেজানো কাঠবাদাম ৫ পিস।
রাতের খাবার: ভাত ১ কাপ অথবা রুটি ২ পিস, সবজি ১ কাপ, মুরগির বুকের মাংস ১ পিস, ডাল ১ কাপ। ঘুমাতে যাওয়ার আগে টকদই ১ কাপ ও কালোজিরা আধা চা–চামচ।